নিজস্ব প্রতিনিধি , কলকাতা - দুর্গাপুজোর ধুনুচি ধোঁয়া মুছে যাওয়ার পর, বাংলার আকাশে আবারও বাজে ঢাকের আওয়াজ—জগদ্ধাত্রী পুজো আসছে। শাক্ত ধর্মবিশ্বাসে ভরপুর এই পুজো আজ পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তে জনপ্রিয়, বিশেষ করে চন্দননগর, কৃষ্ণনগর, সেরামপুর ও কোন্নগর অঞ্চলে। কিন্তু এই পুজোর সূচনা, বিস্তার ও বর্তমান রূপের পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস ও সমাজ-সাংস্কৃতিক বিবর্তনের গল্প।

‘জগদ্ধাত্রী’ শব্দের অর্থই হচ্ছে—যিনি ‘জগতের ধাত্রী’ বা ‘রক্ষাকারিণী’। শাস্ত্রমতে, তিনি দেবী দুর্গারই এক রূপ, যিনি দানব ত্রিপুরাসুরের বিনাশ ঘটান। "কাঠো উপনিষদ"ও "দেবীভাগবত পুরাণ"-এ তাঁর উল্লেখ আছে। পুরাণ অনুযায়ী, একসময় দেবতারা অহংকারে বিভোর হয়ে বিষ্ণু ও শিবের মাহাত্ম্য ভুলে গিয়েছিলেন। তখন দেবী তাদের শিক্ষা দিতে জগদ্ধাত্রীর রূপে আবির্ভূত হন—জ্ঞান, সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক হয়ে। তাই বলা হয়, জগদ্ধাত্রী পুজো মানে আত্মসচেতনতার পুজো।

ইতিহাসবিদদের মতে, বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তন হয় ১৭শ বা ১৮শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। তবে নথিভুক্ত ও সবচেয়ে প্রাচীন পুজোর দাবি করে চন্দননগর। স্থানীয় জনশ্রুতি ও ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৭৫০ সালের দিকে ফরাসি শাসিত চন্দননগরের এক ধনী ব্যবসায়ী ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেন। তিনি ছিলেন গভীর শাক্তভক্ত ও সমাজসেবক। দুর্গাপুজোর পর দেবী আরাধনায় এক বিশেষ রূপ খুঁজতে গিয়ে তিনি জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেন—যেখানে দেবীকে দেখা যায় সিংহবাহিনী, হাতী-আসুর বধেরত, চার হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনু ও তীর ধারণ করে।

ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ির এই পুজোই পরবর্তীকালে গণপুজোর রূপ নেয়। ফরাসি প্রভাবিত শহরে স্থানীয় মানুষ, হিন্দু-ফরাসি সংস্কৃতির সংমিশ্রণে এই উৎসব এক বিশেষ সৌন্দর্য পায়।

চন্দননগরেই আজও জগদ্ধাত্রী পুজো সর্বাধিক জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। এখানে প্রায় ২০০-২৫০টি বড় ও ছোট পূজো হয়, যার মধ্যে অনেকগুলির বয়স ১০০ বছরের বেশি। এই শহরের জগদ্ধাত্রী পুজো শুধু ধর্মীয় নয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও পরিণত হয়েছে। আলোকসজ্জা, থিম, মেলা, ও ঐতিহ্যবাহী প্রতিমাশিল্প—সব মিলিয়ে এটি আজ জাতীয় স্তরে পরিচিত এক উৎসব।

ফরাসি আমলের শহর হওয়ায় চন্দননগরের রাস্তাঘাট, ফরাসি স্থাপত্য ও দেবীপুজোর সমন্বয়ে জগদ্ধাত্রী পুজো পেয়েছে এক অনন্য চরিত্র। বিশেষত, আলোকসজ্জা —চন্দননগরের শিল্পীরা এখানে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছেন। দুর্গাপুজোর থিম আলোকসজ্জার তুলনায় জগদ্ধাত্রীর আলোর কারুকাজে স্থানীয় শিল্পের ছাপ আরও স্পষ্ট।

চন্দননগরের পরেই জগদ্ধাত্রী পুজোর জনপ্রিয় কেন্দ্র হল কৃষ্ণনগর। ১৮ শতকে নবদ্বীপ-নদীয়া অঞ্চলের রাজবংশীয় ও জমিদাররা এই পুজো প্রচলন করেন। কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় নিজেও শাক্ত উপাসক ছিলেন, যদিও তাঁর দুর্গাপুজোই বেশি বিখ্যাত, তবু তার আমলেই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রভাব গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তী কালে সেরামপুর, কোন্নগর, রিষড়া, হুগলি, উত্তরপাড়া ও কল্যাণীর মতো শহরগুলোতেও এই পুজো জনপ্রিয় হয়।

১৯শ শতাব্দীতে নবজাগরণের যুগে বাঙালি সমাজে জগদ্ধাত্রী পুজো ক্রমশ ‘গণপুজো’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যেমন দুর্গাপুজো জমিদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাড়ার পুজোয় পরিণত হয়েছিল, তেমনই জগদ্ধাত্রী পুজোও এক ‘জনতার উৎসব’-এ রূপান্তরিত হয়।

জগদ্ধাত্রী পুজো সাধারণত কার্তিক মাসের শুক্ল নবমী তিথিতে শুরু হয় এবং দশমী বা একাদশী পর্যন্ত স্থায়ী হয়। প্রতিমা তৈরি হয় মৃন্ময়ী মাটিতে—দেবী চার হাতে অস্ত্র ধারণ করে, তার বাহন সিংহ, আর পায়ের নিচে হাতী অসুর। প্রতিমার শোভাযাত্রা, আরতির সঙ্গীত, ধুনুচি নাচ, মেলা ও আলোকসজ্জা মিলিয়ে উৎসবের রূপ হয় চোখ ধাঁধানো।

অন্যদিকে, চন্দননগরে বিসর্জনের শোভাযাত্রা নিজেই এক শিল্প। রাতে আলোকসজ্জিত প্রতিমাগুলি ট্রাকে করে শহরের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে প্রদর্শিত হয়— যা এক বিশাল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়।

আজকের দিনে জগদ্ধাত্রী পুজো শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এটি এক সামাজিক ঐক্যের উৎসব। বিশেষ করে হুগলি জেলার অর্থনীতি ও পর্যটনে এর বিশাল ভূমিকা রয়েছে। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক চন্দননগর ও আশেপাশের অঞ্চলে ভিড় জমায়। পৌরসভা, স্থানীয় প্রশাসন ও পুজো কমিটিগুলি মিলে শহরকে সাজিয়ে তোলে। থিম পুজো, পরিবেশবান্ধব প্রতিমা, এবং ডিজিটাল আলোকসজ্জার ব্যবহার আজকের পুজোকে যুগোপযোগী করে তুলেছে।

এছাড়াও , এই পুজো চন্দননগরের পরিচয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আলোকশিল্পীরা দুর্গাপুজো ও দীপাবলির আলো-সজ্জা বানাতে সারা ভারতে যান—তাঁদের দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের অন্যতম উৎস জগদ্ধাত্রী পুজোই।

জগদ্ধাত্রী পুজো তাই কেবল দেবী আরাধনার উৎসব নয়—এটি বাংলার সংস্কৃতি, শিল্প ও ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। দুর্গাপুজোর ঐশ্বর্য যেখানে বাঙালির আনন্দের প্রতীক, সেখানে জগদ্ধাত্রী পুজো আমাদের আত্মচেতনা, সংযম ও ঐক্যের প্রতীক। ফরাসি প্রভাবিত এক ছোট শহরে জন্ম নেওয়া এই পুজো আজ রাজ্যজোড়া গর্বের উৎসব — আলোর উৎসব, বিশ্বাসের উৎসব, আর বাঙালিয়ানার চিরন্তন পরিচয়।
এর ইতিহাস যেমন রোমাঞ্চকর, তেমনি করুণ পরিণতিও কম নয়
অসংখ্য ভক্ত প্রতিদিন এখানে আসেন মা তারার দর্শনের জন্য
স্বাধীনতার পর রাজপ্রাসাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের কাজ এখন সরকারের হাতে যা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত
প্রথমবারের মতো আইসল্যান্ডে মশার সন্ধান মিলেছে
কিভাবে ঠিক হয়, আর কেনই বা প্রয়োজন হয় নাম দেওয়ার
ডোকরা শিল্প শুধু ভারতের ঐতিহ্যের প্রতীকই নয় বরং বিশ্ববাজারেও ভারতীয় হস্তশিল্পের এক বিশেষ পরিচয় বহন করে
প্রযুক্তির যুগে অনেকেই ভিডিও কল বা অনলাইন ফোঁটার মাধ্যমে এই ঐতিহ্য পালন করেন
আগামী বছরের অক্টোবর থেকে ওয়েলসের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত আরএএফ ভ্যালি ঘাঁটিতে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হবে
আজ এই আলোকসজ্জা শুধু জগদ্ধাত্রী পুজোতেই সীমাবদ্ধ নয়
ঝলমলে বাজির পেছনে রয়েছে হাজার বছরের এক চমকপ্রদ ইতিহাস
বগুলা হাইস্কুল প্রাঙ্গণে কালী পুজোর আয়োজন
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনের প্রকাশিত তথ্যে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছে
মাদক পাচারকারীদের জব্দ করতে মরিয়া চেষ্টা ট্রাম্প প্রশাসনের
রুশ উপকূলে পরমাণু অস্ত্রবহনে সক্ষম ডুবোজাহাজ মোতায়েন আমেরিকার
পাইলটকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে
দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ফের ভারত-পাক সংঘর্ষ থামানোর কৃতিত্ব নিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট