সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৫ দুপুর ০১:৫০ IST

মহালয়া: একটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা সময়কে হার মানিয়েছে

ইন্দ্রনীল রায় - মহালয়া দিনটি হলো পিতৃপক্ষ থেকে দেবীপক্ষের সূচনা, দিনটির সকল ধর্মীয় মাহাত্ম্য ছাপিয়ে যায় বাঙালির এই দিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা সময়কে হার মানিয়েছে, প্রতি বছর আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যায় বাংলার ঘরে ঘরে একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। আপাতত বাঙালি নিজের সুখ নিদ্রা ত্যাগ করে ভোর চারটেয় ঘুম থেকে উঠে রেডিও বা ইউটিউবের সামনে বসেন।যদিও এক্ষেত্রে টেলিভিশন ও কোন অংশে পিছিয়ে নেই।

তবে বাঙালি মহালয়া বলতে যেটা বোঝে সেটা রেডিও, রেকর্ডিং আর একটি অমর কণ্ঠ। ১৯৩১ সাল। অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে প্রথমবার সম্প্রচারিত হলো 'মহিষাসুরমর্দিনী'। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরে বাঁধা গান। এটাই বাঙালির কাছে দেবীর আগমনের শুভ সূচনার দিন - এটি এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা প্রায় একশো বছর ধরে বাঙালির সমগ্র চেতনার অংশ হয়ে গেছে। 

তারপর থেকে প্রতি বছর, প্রতি মহালয়ায় এই একই রেকর্ডিং বাজে। ১৯৬৬ সালে একবার নতুন রেকর্ডিং করার চেষ্টা হয়েছিল। জনরোষে সেটা বন্ধ করে দিতে হয়। স্বয়ং মহানায়ক উত্তমকুমার ও এখানে দর্শকের মন জয় করতে অক্ষম, ভাবুন একবার - একটি অডিও রেকর্ডিং, যা প্রায় নব্বই বছরের পুরনো, আজও একইভাবে গ্রহনযোগ্য। নেটফ্লিক্স এর যুগে দাঁড়িয়েও মানুষ সেই একই কণ্ঠের "আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক-মঞ্জীর..." দিয়েই বাঙালি নিজেদের শারদীয়া উদযাপন শুরু করে। এটা শুধুমাত্র আবেগ নয় , এটা আসলে একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, যা প্রতিটি বাঙালি তাদের বহবান যুগের নদীটির সাথে বিয়ে নিয়ে চলে।

ডিজিটাল যুগের মহালয়া: Tradition Meets টেকনোলজি

আজকাল মহালয়া মানে শুধু রেডিও নয়। ভোর বেলা চোখ মেলে চাইবার আগেই পাড়ার মোরে মাইকে বেজে ওঠে মহিষাসুর মর্দিনি। ইউটিউবে এ 'Mahishasuramardini' সার্চ করলে লাখ লাখ ভিউ দেখা যায়। Spotify-তে প্লেলিস্ট তৈরি হয়। Instagram-এ স্টোরি শেয়ার হয় চণ্ডীপাঠের লাইন দিয়ে। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানেন? Content-টা সেই একই। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সেই গম্ভীর উচ্চারণ - "নমোস্তস্যৈ নমোস্তস্যৈ নমোস্তস্যৈ নমো নমঃ"। Platform বদলেছে, আবেগ বদলায়নি।
 

মহালয়ার সোশিওলজি: 
কেন এত তাৎপর্য দিন? মহালয়া মানে পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষের মিলনক্ষণ, যেখানে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে তর্পণ করা হয় এবং দেবীপক্ষের সূচনা হয় ও দুর্গা মর্ত্যে আগমন করেন। এটা দুর্গাপুজোর official countdown শুরুর ঘোষণা। কিন্তু এর থেকেও বড় কথা, এটা বাঙালির সাংস্কৃতিক ক্যালেন্ডারের একটা reset button। Corporate world-এ যেমন fiscal year থাকে, বাঙালির কাছে মহালয়া থেকে কালীপুজো - এই দুই মাস হলো emotional fiscal year। এই সময়টায় সব হিসাব-নিকাশ মিটিয়ে নতুন করে শুরু করার একটা অলিখিত চুক্তি। মহালয়ার পর দেবীপক্ষ - উদযাপনের সময়। এই পরিবর্তন টা খুবই সুচিন্তিত। উৎসবে যাওয়ার পূর্বে ও নিজের পূর্বপুরুষ দের স্মরণ করা, তাদের আশীর্বাদ ভালোবাসা নিয়ে একটা শুভ সময় কে নিজের জীবনে আহবান করা। মহালয়া সেই দিন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বললে, এটা collective grief processing থেকে collective joy preparation-এর একটা সেতু।  Smart, isn't it?

অসুর বধ: মহিষাসুর হিন্দু পুরাণের এক অর্ধ-মহিষ, অর্ধ-মানব রাক্ষস, যিনি স্বর্গরাজ্য দখল করেছিলেন, সে  শক্তিশালী,পুরুষালি, আপাতদৃষ্টিতে অজেয় একটি শক্তি। দেবী তাকে পরাস্ত করে, 'মহিষাসুরমর্দিনী' নামে রচনা করেছেন নারীশক্তির জয়ের গাঁথা। এই ব্যাখাটি এত কেন জনপ্রিয়? কারণ এটা আসলে একটা সর্বজনীন ন্যায়বিচারের গল্প । David vs Goliath, ভালো vs মন্দ - এই eternal conflict-এর একটা বাঙালি সংস্করণ। প্রতি বছর এই গল্প শুনে আমরা নিজেদের মনে করিয়ে দিই যে অন্যায় যত শক্তিশালীই হোক, শেষ পর্যন্ত ন্যায়ের জয় হবেই।

Economic Impact: মহালয়ার খানিক আগে থেকেই শুরু হয় বাংলার এর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বাজার। অসংগঠিত বিক্রেতা থেকে সংগঠিত খুচরা বিক্রেতা- সবাই এই দুই মাসের জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে। Amazon আর Flipkart-এর 'Pujo Special Sale' শুরু হয় মহালয়া থেকেই। Local দর্জির দোকান থেকে বড় fashion house - সবার peak season এটাই। GPay আর Paytm-এ 'Pushpanjali' offer চালু হয়। তথাকথিত অর্থনীতি আর ডিজিটাও অর্থনীতির-র একটা সুন্দর মেলবন্ধন ঘটে এই সময়।

Diaspora Connection: প্রবাসে মহালয়াটা হয়তো একটু আলাদা, শত কাজের ভিড়েও ভারতীয় এই সময় টাকে এলার্ম দিয়ে রেখে হয়তো একটু বাঙালিয়ানা খুঁজে নেওয়ার স্বাদ উপভোগ করে। Zoom call-এ একসাথে পরিবার কিংবা প্রিয় বন্ধুদের সাথে মহিষাসুরমর্দিনী শোনা, বাংলায় না ফেরার চাপা কষ্ট আজকের দিনে সকল প্রবাসীর হৃদয়ে ব্যথা দেবেই। ফেসবুক লাইভ হোক কিংবা অন্যান্য হাজার রকমের উপায়, যা দিয়ে তারা প্রতি মুহূর্ত দেশের মানুষের সাথে যোগাযোগ রাখে কিন্তু এই পুজোর সময় টা দেবীর আগমনের বার্তা তাদের ও জানিয়ে দেয় তারা মনে প্রাণে কতটা বাঙালি।প্রবাসে মহালয়া আরও বেশি অর্থবহ, কারণ এটা তাদের আসল মাটির এর সাথে সংযোগ। বীরেন্দ্র কৃষ্ণের সেই পরিচিত কন্ঠস্বর তাদের নিয়ে যায় ফেলে আসা দেশে, ফেলে আসা সময়ে।

Generation Gap? 
সবচেয়ে আবেগপ্রবণ বিষয়  হলো - মহালয়ার দিনটি সব বয়সের মানুষের মধ্যে একটি মজবুত সেতু তৈরি করে দেয়। যে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া যুবক কিংবা যুবতীটি সারাদিন K-pop,k-drama র বাইতো বেরোতে শেখেনি, সেও মহালয়ার দিন চণ্ডীপাঠ শোনে। যে দাদু স্মার্টফোন চালানোর বিন্দুমাত্র আগ্রহ কোনদিন দেখায়নি, তিনিও YouTube-এ মহিষাসুরমর্দিনী search করতে শেখেন। এটা সম্ভব হয় কারণ এই দিনটি কাউকে চাপিয়ে দেওয়া হয় না, দিনটি প্রতিটি বাঙালি নিজের করে পেয়েছে আজন্ম। এটি বাঙালির আভিজাত্য।

The Future of মহালয়া 

AI আর Metaverse- 
এর যুগে মহিষাসুর মর্দিনী কোথায় যাবে? হয়তো VR headset পরে আমরা দেখব দেবী দুর্গার অসুর বধ। হয়তো AI-generated voice দিয়ে নতুন চণ্ডীপাঠ হবে। কিন্তু দিনটির মাধুর্য টা থাকবে একই। কারণ দিনটি প্রযুক্তির র মুখাপেক্ষী নয়। দিনটি আমাদের বহমান সাংস্কৃতিক গতির পরিচয়। দিনটি একসাথে কিছু উদযাপন করার দিন।

প্রতিনিয়ত যুগের থাকে তাল মিলিয়ে পৃথিবী বদলাচ্ছে , কিন্তু কিছু জিনিস একই থাকে।সেরকম মহালয়া দিনটিও বাঙালির কাছে অপরিবর্তনীয়। এটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা কে, কোথা থেকে এসেছি? মহালয়া দিনটি ধর্মীয় আবেগের সাথে যুক্ত হলেও, দিনটি বাঙালির ঐতিহ্য, প্রতিটা বাঙালির অনুভূতি। এটা ধ্রুব সত্য যে কিছু কিছু নিয়ম এত গভীর ভাবে আমরা লালন পালন করি যে সময় তাদের আরও শক্তিশালী করে। পরের বার যখন ভোর চারটেয় alarm বাজবে মহালয়ার দিন, মনে রাখবেন - আপনি শুধু একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান শুনছেন না। আপনি অংশগ্রহন করছেন বাঙ্গালীর শতাব্দী পুরোনো এক ইতিহাসে, যা দেশ কাল পাত্র নির্বিশেষে আপামর বাঙালিকে কে এক সুতোয় বাঁধে। 
And that, my friend, is pretty epic.

সবাইকে দেবীপক্ষের শুভেচ্ছা। যুগ বদলাক, মহালয়া থাকুক। 

(বাংলার মাঝে ইংরেজি দেখে যারা ভুরু পুচকালেন তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, অপরাধ করেছি তবে নতুন পাঠকদের সুবিধার্তে এই কাজ, তারা চেষ্টা করেছে বাংলা ভাষাকে আপন করার তবে সমাজের চাপে তারা নাজেহাল, তাই একটু একটু করে বাংলাতে ফেরার ডাক দিচ্ছি, রাগ করবেন না)

ইন্দ্রনীল রায়, অতিথি অধ্যাপক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

TV 19 Network NEWS FEED

‘সান্ত্বনা’ পুরস্কার! ইজরায়েলের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মানে সম্মানিত ট্রাম্প

‘সান্ত্বনা’ পুরস্কার! ইজরায়েলের সর্বোচ্চ অসামরিক স...

ট্রাম্পের নোবেল হাতছাড়া হওয়ার ক্ষতে প্রলেপ

গৃহযুদ্ধে জ্বলছে পাকিস্তান! সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, ‘নিষ্ঠুর’ পুলিশের গুলিতে মৃত ১৩

গৃহযুদ্ধে জ্বলছে পাকিস্তান! সরকারবিরোধী বিক্ষোভ, ‘...

বিক্ষোভ রুখতে নির্মম দমননীতির পথ বেছে নিয়েছে শাহবাজ শরিফের প্রশাসন

মর্মান্তিক দুর্ঘটনা দক্ষিণ আফ্রিকায়, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ল বাস, মৃত ৪২

মর্মান্তিক দুর্ঘটনা দক্ষিণ আফ্রিকায়, নিয়ন্ত্রণ হার...

হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ প্রশাসনের