সোমনাথ: ইতিহাসের ধুলো মুছে জেগে ওঠা এক অগ্নিজ্যোতি
শ্রাবন | জ্যোতির্লিঙ্গ | পর্ব ১
নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা - “তুমি শিবকে ধ্বংস করতে পারবে না। তিনি সময়ের আগে জন্মান, সময়ের পরে জেগে থাকেন।”
এই বাক্যটাই যেন গভীর ভাবে সত্যি হয়ে থাকে ভারতের পশ্চিম উপকূলে দাঁড়িয়ে থাকা সোমনাথ মন্দিরকে ঘিরে। শিবের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে প্রথম,এই তীর্থ শুধু পূজার স্থান নয়, এটি এক জাতির আত্মপরিচয়ের স্তম্ভ।
শ্রাবণ মাসে, যখন ভগবান শঙ্করের মাহাত্ম্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়, তখন লক্ষ লক্ষ ভক্ত সোমনাথের উদ্দেশে রওনা দেন,হৃদয়ে ভক্তি, মুখে 'ওঁ নমঃ শিবায়', কাঁধে গঙ্গাজল, আর চোখে মোক্ষের আকাঙ্ক্ষা।
পুরাণের পাতায় সোমনাথ: চাঁদের তপস্যা, শিবের করুণা
হিন্দু পুরাণে বর্ণিত আছে,চন্দ্রদেব রোহিণীকে অতিরিক্ত ভালোবাসায় তাঁর শ্বশুর প্রজাপতি দক্ষ অভিশাপ দেন, যার ফলে তিনি ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকেন। মুক্তির আশায় তিনি কঠিন তপস্যায় বসেন এই ভূমিতে। তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব নিজে আবির্ভূত হন এবং চন্দ্রদেবকে পুনরায় জীবনীশক্তি দেন।
এইখানেই শিব প্রথম ‘সোমনাথ’ রূপে পূজিত হন অর্থাৎ চন্দ্রদেবের ঈশ্বর। এই স্থান তখন থেকেই পরিণত হয় এক অলৌকিক শক্তিকেন্দ্রে। পুরাণ বলে, যে কোনও ব্যক্তি এই স্থানে ভক্তি সহকারে শিবের দর্শন করলে তার জন্মজন্মান্তরের পাপ ক্ষয় হয়।
সত্যিই কি কেবল মন্দির? না কি, এক সংগ্রামী আত্মার মূর্তি?
তথ্যভিত্তিক ইতিহাস বলছে, সোমনাথ মন্দির গঠিত হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকেই। কিন্তু এই মন্দিরটিই বহুবার রাজনীতির, লোভের এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বলি হয়েছে।
ধ্বংস, লাঞ্ছনা আর প্রতিঘাত,সোমনাথ যে ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী মন্দির
সোমনাথ মন্দিরের ইতিহাস যেন এক দীর্ঘ যন্ত্রণার কাব্য। এখানে দেবতাকে কেবল পূজিত করা হয়নি, তাঁকে অপমানিতও করা হয়েছে। কিন্তু সেই অপমানের ভেতর দিয়েই তিনি হয়েছেন আরও মহান, আরও অনড়।
সারা ভারতবর্ষে যদি এমন কোনও তীর্থ থাকে যাকে সবচেয়ে বেশি বার ধ্বংস করা হয়েছে, তবে সে হল সোমনাথ।
১৭ বার আক্রমণ হয়েছে এই মন্দিরের উপর,শুধুই ধর্মের নামে, লোভের নামে, আর এক সভ্যতাকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টায়।
১০২৬ খ্রিস্টাব্দে, আফগান আক্রমণকারী মহম্মদ গজনি লক্ষাধিক সেনা নিয়ে সোমনাথ আক্রমণ করেন।
মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকে, তিনি শিবলিঙ্গ ভেঙে ফেলে তার টুকরো কাবুলের মসজিদে নিয়ে যায়। সে সময় প্রাচীন সোমনাথ মন্দির ছিল সোনা, রত্ন, রূপার দ্বারা অলংকৃত, ভেতরে ছিল ৫০,০০০ এরও বেশি ভক্ত এবং সন্ন্যাসী। হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়ে শিবলিঙ্গ রক্ষা করার চেষ্টা করেন।
পরে আলাউদ্দিন খিলজি, দিল্লির সুলতান মাহমুদ, আওরঙ্গজেব সহ বহু মুসলিম আক্রমণকারী একের পর এক সোমনাথ মন্দিরে আঘাত হানেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, হিন্দু ভক্তির মেরুদণ্ডকে চূর্ণ করে দেওয়া।
প্রতিবার মন্দির ধ্বংস হয়েছে, প্রতিবার শিবলিঙ্গ ভাঙা হয়েছে,কিন্তু কখনও শেষ হয়নি শিবের মাহাত্ম্য।
প্রতিবারই কোনও না কোনও ভক্ত, কোনও রাজা, কোনও জনতা এই মন্দিরকে আবার গড়েছেন কারণ এই মন্দিরে পূজিত হচ্ছেন শুধুই শিব নন, সত্য, সাহস, আত্মসম্মান ও বিশ্বাস।
সবশেষে, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পরে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এই মন্দিরকে নতুন করে গড়ে তোলেন। তখনকার প্রেসিডেন্ট ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন:
“সোমনাথ মন্দির শুধুই একটি ধর্মস্থান নয়, এটি ভারতবর্ষের আত্মার প্রতীক।”
এই কথাই প্রমাণ করে,সোমনাথ আসলে সংস্কৃতি আর আত্মবিশ্বাসের শিলালিপি, যার উপর কোন আক্রমণই চিরস্থায়ী হতে পারেনি।
সোমনাথ যেন বলে, ভক্তি আর সাহসের সামনে কোনো দুঃসময় চিরস্থায়ী নয়।
শ্রাবণ মাসে সোমনাথ: আকাশ,সমুদ্র,ভক্তির ত্রিভুজে এক মহামিলন
সোমনাথের শিবলিঙ্গ, নীরব অথচ দীপ্তিমান এক জ্যোতির্কণা।বর্তমানে সোমনাথ মন্দিরের গর্ভগৃহে বিরাজ করছেন এক অনবদ্য কালো শালগ্রাম শিবলিঙ্গ, যাঁকে ঘিরে বিরাজ করছে এক অতল শক্তি। তিনি জ্যোতির্লিঙ্গ, অর্থাৎ স্বয়ং শিবের জ্যোতিরূপ।
এখানে কোনও ধাতব অলংকার নেই, নয়নাভিরাম নয়, রত্নখচিতও নয়,
কিন্তু তাঁর একটুকরো রূপেই জেগে থাকে হাজার বছরের বিশ্বাস।
শিবলিঙ্গটি আয়তনে মাঝারি, কালো পাথরের, যার উপর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে অবিরাম জলধারা ও বিল্বপত্র নিবেদন। ভেতরের গর্ভগৃহে ধূপ, গঙ্গাজল ও মন্ত্রোচ্চারণে যে পরিবেশ তৈরি হয় তা যেন সময়কে থামিয়ে দেয়।
এই শিবলিঙ্গের সামনে দাঁড়িয়ে একটাই অনুভূতি আসে “তুমি যতই আঘাত করো, আমি ততই দীপ্ত হবো।”
সন্ধ্যার আরতিতে যখন শিবলিঙ্গের উপরে আলো পড়ে, তখন মনে হয় যেন তাঁর ভিতর থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রের সীমানা পর্যন্ত।
শ্রাবণ মাস শিবের জন্য সর্বোচ্চ পবিত্র। এই মাসেই গঙ্গাজল দিয়ে শিবকে স্নান করালে ভক্তের যাবতীয় ইচ্ছা পূর্ণ হয় বলে বিশ্বাস। সোমনাথে শ্রাবণ মাসে এক অদ্ভুত শক্তির উপস্থিতি অনুভব হয়,যেন হাজার হাজার বছরের তপস্যার ধ্বনি বাতাসে মিশে গেছে।
প্রতি সন্ধ্যায় এখানে সমুদ্রঘেঁষা আরতিতে উপস্থিত থাকলে মনে হয় যেন আকাশের সঙ্গে কথা বলছেন দেবতা স্বয়ং। পূজার ঘণ্টা, ঢোল আর শঙ্খের শব্দে গঙ্গাজলের গন্ধ মিশে গিয়ে যেন এক অপার্থিব পরিবেশ তৈরি করে।
সোমনাথ কীভাবে যাবেন?
সোমনাথ অবস্থিত গুজরাটের গির সোমনাথ জেলাতে।
সবচেয়ে কাছের রেলস্টেশন: ভেরাভল (মাত্র ৭ কিমি)।
দিউ বিমানবন্দর থেকে সোমনাথ ৮০ কিমি দূরে।
গুজরাটের যেকোনো বড় শহর (রাজকোট, জুনাগড়, আহমেদাবাদ) থেকে সড়কপথে সহজেই যাওয়া যায়।
সোমনাথের আশেপাশে দর্শনীয় স্থান:
এই তীর্থ শুধু শিবময় নয়, ইতিহাস ও প্রকৃতিরও মিলনক্ষেত্র:
ত্রিবেণী সংগম-গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর অলৌকিক মিলনস্থল। এখানেই বলে হয়, আত্মা মুক্তি পায়।
ভালুকা তীর্থ- পাণ্ডবদের সঙ্গে জড়িত, শ্রীকৃষ্ণ এখানেই তাঁর শেষ লীলা সম্পন্ন করেন।
সোমনাথ সমুদ্রতট – সূর্যাস্ত দেখার এক অবর্ণনীয় স্থান।
সরস্বতী তীর্থ ও মিউজিয়াম – ইতিহাস ও স্থাপত্য প্রেমীদের জন্য অপরিহার্য।
সোমনাথ যেখানে দেবতা কেবল পূজিত নন, অনুভবযোগ্য
সোমনাথকে যদি কেবল একটি মন্দির বলি, তবে তা হবে অর্ধসত্য। এখানে এসে আপনি অনুভব করবেন,কীভাবে যুগ যুগ ধরে কোনো শক্তিকে থামানো যায় না, যদি সেই শক্তি সত্য, নির্ভীক এবং আত্মবিশ্বাসের উপর গড়ে ওঠে।
একবার ধ্বংস, আবার পুনর্গঠন,এই চক্রেই সোমনাথ এক প্রতীক হয়ে উঠেছে মানবজাতির সংগ্রামের, সাহসের এবং আত্মবিশ্বাসের।
এখানে দাঁড়িয়ে আপনি দেখবেন না কেবল শিবলিঙ্গ,আপনি দেখবেন এক আত্মার দীপ্তি।
শ্রাবণ মাসে, ভক্তের মুখে উচ্চারিত প্রতিটি “ওঁ নমঃ শিবায়” যেন এই মহাজ্যোতির সঙ্গে মিশে এক হয়ে যায়।
এই তীর্থে এসে মানুষ কাঁদে না, মানুষ জেগে ওঠে।
চলবে....
[পরবর্তী পর্ব: দক্ষিণ ভারতের অরণ্যে বসে থাকা দেবাধিদেব — মাল্লিকার্জুন মহাতীর্থ]